আমার সান্দাকফু আরোহন বৃত্তান্ত

আমার সান্দাকফু আরোহন  বৃত্তান্ত 

বছরের শেষ কয়েকদিন বেশ খানিকটা রোমাঞ্চকর ভাবে কাটাবার আশায় বন্ধুদের সাথে মিলে সান্দাকফু যাবার প্ল্যানটা করেই ফেলা গেল।  ২৫ডিসেম্বর যাত্রা শুরু আর ৩১শে  ফেরা। ২০১৪ তে জীবনের প্রথম ট্রেকিং করার আশায় আমি রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পরেছি তখন। ধর্মতলা ঘুরে ঘুরে ট্রেকিং ব্যাগ গরম জামাকাপড় কেনা হলো ;সান্দাকফুতে ডিসেম্বরে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে চলে গেছে বলে জানা গেছে,তাই আমরা  নিজেদের বাঁচাবার সবরকম জিনিসই ট্রেকিং ব্যাগে মোটামুটি মজুত করতে পেরেছিলাম। কিছু  অভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ অনুযায়ী  আদার মোরব্বা,মধু ,দড়ি ,জোগাড় করা হলো না বলে খানিকটা শঙ্কাও ছিল তা অস্বীকার করব না। ধর্মতলা থেকে বাসে উঠে পড়লাম। আমার আবার বাসে উঠলেই কিরকম 'বমি পাচ্ছে ,বমি পাচ্ছে ' মনে হয়;তাই রিস্ক না নিয়ে পতির সাথে ঝগড়াঝাটি করে জানলার ধারটা আদায় করলাম(ব্যাটা কিছুতেই বসতে দিচ্ছিল না);মোটামুটি ১৬ টি ঘন্টা ক্লান্তিকর বাস জার্নির পর আমরা নামলাম শিলিগুড়ির মাটিতে। মাঝে বাসযাত্রার বাথরুম এপিসোডটা ইচ্ছে করেই বাদ দিলাম।শিলিগুড়ির হোটেলে স্নান ক্র্ক্ষে গিয়ে মাইতির ভুল জায়গায় গরম জল ঢেলে লাফালাফি করা ছাড়া আর তেমন বিশেষ কিছু ঘটেনি। ইতিমধ্যে সৌরভ ও পাতির সৌজন্যে গাড়ির ব্যবস্থাও রেডি।একটু চা -বিস্কুট খেয়ে সিধা গাড়িতে।  ও বলা হয়নি যে এই ট্যুরে শিলাদি (আমাদের অভিভাবিকা স্বরূপা ) আর তার ছেলে জিত আমাদের সঙ্গী। বলাই বাহুল্য যে শিলাদি থাকে আমাদের উচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে  হচ্ছে। গাড়ি এগোচ্ছে পাহাড়ের দিকে- ক্রমশ কথা বাড়তে থাকে। প্রথমেই জিত ও সৌরভের মধ্যে মেসি ও রোনাল্ডোকে নিয়ে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শুরু হলো। আমরাও মেতে উঠলাম তা নিয়ে ,কিন্তু হঠাত সবাই চুপ!!!!!! কেন ?? না কে যেন খবর পড়ার মত করে বলছে-here are my friends,arka,wasim,sourav ...সবার মাথা পিছন দিকে তাকাতেই রহস্য বোঝা গেল। পাতিবাবু নিজের ক্যামেরায় ভিডিও করতে করতে আমাদের ইন্ট্রো দিচ্ছেন।(পরে সারা ট্যুরেই এই জিনিস চলতে থাকবে ).খানিক পরে শোনা গেল পাতিবাবু গান করছেন। ইতিমধ্যে মাইতি পাহাড় দেখে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত। পারলে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে যায়।কিন্তু গাড়ি পাহাড়ে যত উঠতে লাগলো ততই সবার মুখ ক্রমশ বন্ধ। কারন বেশ  খাড়াই  রাস্তা। আর এই দলে আমি আর সৌরভ ছাড়া কারোরই পাহাড় চড়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। ড্রাইভার খানিক পরে গাড়ি দার করলো একটা রেস্টুরান্টএর  সামনে। 'খাওয়াদাওয়া  করে নিন ` এই তার নির্দেশ। আমরা নেমে পরলাম। মোমো খেতে খেতে মাইতির এত ভালো লাগলো যে পরপর দু প্লেট সাবাড় না করে থামল না। পরে অবশ্য চিকেন মোমোতে চিকেনের বদলে 'অন্য কিছু  ছিল না তো ` গোছের সন্দেহ প্রকাশ করায়  আমরা তাকে আশ্বস্ত করলাম যে যাই থাকুক না কেন সেটা খাওয়া হে গেছে  আর হাজার চেষ্টা করলেও বেরোবে না। উপরন্তু কে একজন পাহাড়ে মুরগির বদলে গরুর মাংস দিয়ে থাকে বলে ভয় দেখানোর পর মাইতি বাকি রাস্তা আর বিশেষ কথা বলল না। ওয়াসিম আগাগোড়াই চুপচাপ ছিল ,আমি ভাবলাম সে হয়তো চারপাশের অসাধারণ প্রাকিতিক দৃশ্য দেখে বাক্যহারা হয়ে গেছে। কিন্তু না,পরে শুনি যে 'যা রাস্তা,ভয়ে আমার বুক কাঁপছিল রীতিমত `... এরকম কিছু টুকরো টুকরো ঘটনার মধ্যে দিয়ে  সন্ধে  নাগাদ  আমরা পৌছলাম মানেভাঞ্জন। যেটা কিনা  gateway of sandakphu বলা যেতে পারে।
গাড়ি থেকে নেমেই বুঝলাম তাপমাত্রা কলকাতার থেকে অন্তত ১৫ ডিগ্রী কম। পুরু জ্যাকেট পড়েও দাঁতে দাঁতে লেগে যেতে থাকলো। আমাদের 'হোটেল ব্যবস্থাপক ` সৌরভ ও পাতি  ইতিমধ্যে হোটেল ঠিক করে ফেলেছে। চমত্কার একটা কাঠের দোতলা বাড়িতে আমাদের জায়গা হলো। নিচের তলায় আমি ,ওয়াসিম ,সৌরভ ,মাইতি  আর উপরের তলায় শিলাদি আর তার ছেলের সাথে পাতি। পাতি খুব গাইগুই করলেও আমরা পাষানসম হৃদয়ে অটল রইলাম। ইতিমধ্যে ঠান্ডার সাথে লড়াই করার জন্য একটা ব্র্যান্ডির বোতল`ও কেনা হলো। এসেই যখন পরেছি তখন অনুসাঙ্গিকে ফাঁক রাখি কেন।? রাতের খাওয়া হলো মত মত হাতরুটি,ডিমের কারী,আচার আর সালাদ। খাওয়াদাওয়া সেরে পাতি চলে গেল উপরে ,আমরা রাত কাটাবার জন্য তৈরী হতে থাকলাম।  ব্র্যান্ডির বোতল খুলে গ্লাস,কাপের সাহায্যে মেরে দিলাম সবাই। তারপর সোজা দুটো কম্বলের তলায়। খানিকক্ষন পর ব্র্যান্ডির  খেল শুরু হলো। মাইতি 'উফ  কি গরম ` বলে প্রথম কম্বল,তারপরে দ্বিতীয় কম্বল ,ক্রমান্বয়ে গায়ের জ্যাকেট,উইন্ডচিটার খুলে কোটসউল পড়েই শুয়ে পড়ল।আমরাও গরম অনুভব করছিলাম কিন্তু মাইতির মতো না।  খানিকটা ঘুম আসার পর বাইরে গোলমাল শুনে সবার ঘুম গেল চটকে। অনেক টর্চের আলো আর উত্তেজিত লোকেদের গলা শুনে আমরা ধরে নিলাম যে নির্ঘাত চিতাবাঘ এসেছে। আমি আর সৌরভ উঠে সদর দরজাটা  সব চেয়ারগুলো দিয়ে আটকালাম,বাথরুমের জানলা বন্ধ করলাম। আমার কাছে একটা ছুরি ছিল সেটা বালিশের তলায় নিয়ে শুলাম। পরের দিন সকালে উঠে শুনি চিতাবাঘ না ছাই !!দুটো লোকের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছিলো। একটা আডভেঞ্চার মূলক ভাবনা একদম মাঠে মারা গেল।

এরমধ্যে পাতি আর সৌরভ গিয়ে অফিস থেকে ট্রেকিং পারমিশন নিয়ে এলো। ১৫ মিনিটের মধ্যে এসে পড়ল মিংমা আমাদের গাইড টু সান্দাকফু। ১৬-১৭ বছরের ছোকরা ,স্কুলে পড়ে,কিন্তু পাহাড় চড়ার বাবা ঠাকুরদা গুলে খেয়েছে। পিঠে ব্যাগ এঁটে আমাদের যাত্রা হল শুরু। কিন্তু দুটো বাঁক ঘুরেই কয়েকজন কাত হয়ে পড়লাম। প্রচন্ড হাঁপানি,গলা কাঠ,মাথা ঘুরছে,শ্বাসকষ্ট। ঝটপট সবাইকে কোকা-৬ ওষুধ দিলাম। শ্বাসকষ্ট একটু কমলেও বুঝতে পারলাম যে আর বেশিক্ষণ নয়। দম শেষ হয়ে আসছে। অবস্থা এমন জায়গায় চলে গেল যে ঠিক হলো আমি আর পাতি একটা গাড়ি ভাড়া করে সবার ব্যাগগুলো নিয়ে টামলিং গ্রামে গিয়ে অপেক্ষা করব। মন খারাপ নিয়ে উঠে পরলাম গাড়িতে।  ওরা পায়ে হেঁটে আসতে লাগলো। টামলিং এ গিয়ে ব্যাগ পত্র রেখে আমি,পাতি আর শিলাদি চারপাশের দৃশ্যাবলী উপভোগ করতে  লাগলাম।  ইতিমধ্যে পাতির মনে দারুন উত্তেজনার সঞ্চার হওয়ায় (এবং আমারও ) আমরা কাছাকাছি একটা ছোটখাটো পাহাড় চূড়োয় (নাকি টিলায় ?) উঠে বসে রইলাম। পাতি এখানেই তার বিখ্যাত 'কত মোটা মোটা লোক কত শৃঙ্গ জয় করছে ' উক্তি আমায় প্রদান করেছিল। আমাদের পুরো টুরের সবচেয়ে ভালো ভিডিও ও এখানেই হয়েছিল ,কিন্তু যান্ত্রিক গোলযোগে সেই অমূল্য ভিডিও ডিলিট হয়ে যায়। ইতিমধ্যে বাকিরা এসে না পৌঁছনোর কারনে শিলাদি প্রচন্ড চিন্তিত হয়ে পড়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়ায় আমি,পতি দুজনে মিলে নিচের দিকে এগিয়ে যাওয়া শুরু করলাম। রাস্তায় আরো কিছু অভিযানকারী দলের সাথে দেখা হয়ে গেল। কিন্তু আমাদের বাকি লোকদের বর্ণনা শুনে তারা একবাক্যে জানিয়ে দিলো যে না এমন কোনো লোকদের তারা দেখতে পায়নি। চিন্তা এবার শিকড় গেড়ে বসছিল মনের মধ্যে। আমরা একটা উঁচু চূড়োয় দাঁড়িয়ে চারপাশে নজরদারি শুরু করলাম।just like an watch tower। হঠাৎ পতি আবিষ্কার করলো দূরে পাহাড়ের বাঁকে একটা উজ্জ্বল জ্যাকেট দেখা যাচ্ছে,যা কিনা নিশ্চিত জিতের গায়েই ছিল। ব্যাস! আর কি! চিৎকার করে উঠলাম ওয়াসিমের নাম ধরে। অতি পরিচিত শব্দবন্ধ এর মাধ্যমে ওয়াসিম প্রত্যুত্তর জানালো বহু দূর থেকে।উঁচু থেকে এবার সবাইকেই দেখা যাচ্ছিল। পতি প্রাণের উচ্ছ্বাসে দৌড়ে নীচে নামতে যাচ্ছিলো।আমি আটকালাম,সামনে ছোট ঝর্ণা,পা ফসকালে অবধারিত মৃত্যু। খানিকক্ষণ পর পুনর্মিলন উৎসব।
টামলিং গ্রামে আমাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হয়েছিল একটা ছোট্ট লজে।কাঠের বেশ বড়ো ঘরে পাতা আটটা খাট with কম্বলের স্তূপ। ম্যাগি খাওয়া হলো তার পরেই।প্রচন্ড ঠান্ডায়, ধোঁয়া ওঠা নুডলস খেতে যা চমৎকার লাগলো কি বলবো! বাড়িতেও তো ম্যাগি খাওয়া হয়,কিন্তু এত সুস্বাদু তো লাগে না। তারপর সবাই মিলে বেরোনো হলো চারপাশ ঘুরতে।সেই টিলার উপর এবার সবাই মিলে উঠে ফটোশুট হয়ে গেলো একপ্রস্থ। শুনলাম রাতে বরফ পড়তে পারে। বেশ থ্রিলিং লাগছিলো। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথে নেমে এলো তাপমাত্রা।ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে আমরা কাঠের ঘরে ঢুকে পড়লাম,এবং গায়ে আরেকপ্রস্থ জ্যাকেট চাপালাম সবাই। গল্প-আড্ডার সাথে সাথে যোগ হলো মুড়ি-চানাচুর-শশা ইত্যাদি ইত্যাদি। সৌরভ দাসের জোগাড় যন্ত্র দারুন হয়েছিল no doubt।আমাদের গাইড মিংমাকেও দেওয়া হয়েছিল। পতির আচার কাজে লেগেছিল ওই মুড়ি মাখার সময়েই।(তবে ঘি টা কাজে লাগেনি একদম)।
সে রাতে গল্প আর মজা যা হয়েছিল তার ফলে লজের লোকেরা আমাদের দরজায় এসে বলে গেল 'থোড়া ধীরে থোড়া ধীরে'। ও বলাই হয়নি,এই রাতেই THE GREAT TUMLING CONSPIRACY CASE চালু হয়,যার গোড়াপত্তন মাইতির মুখে। আসলে আমাদের টাকা পয়সা কিছুটা কমে এসেছিল গাড়ি ভাড়া কিছুটা অত্যাধিক হওয়ায়। পতি, আমাদের স্বঘোষিত হিসাবরক্ষক যেই না হিসাব কষে বললো,আমরা সান্দাকাফু যেতে পারি কিন্তু সেখানে থাকার পয়সা নেই- ব্যাস,প্রথমেই সৌরভ রেগে গিয়ে বলে,কেন??এত টাকা করে যে আনা হলো তা গেল কোথায়??? মাইতি অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে কি একটা ভাবছিলো, লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে পতিকে বললো,'হয়ে গেছে,হিসাব হয়ে গেছে' তারপর একটা বড়োসড়ো হিসাব দাখিল করে দিয়ে বললো, এবার বলো, কোথায় বাকি টাকা?? বলো কোথায় বাকি টাকা?? পতি রেগে গিয়ে বলে,আমি কোনো হিসাব দেব না। টাকা নেই,ব্যাস নেই। হাওয়া বেশ গরম হয়ে ওঠার মুহূর্তে আমি আর ওয়াসিম আবিষ্কার করলাম যে মাইতির হিসাবে গলদ আছে। বেশ কিছু হিসাব না ধরেই মাইতি তার স্বরচিত হিসাব পেশ করেছে।বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে থামানো হলো।কিন্তু পতি জানিয়ে দিলো যে সে আর ক্যাশ সামলাতে পারবেনা,এমন অপবাদের বোঝা নিয়ে চলতে সে রাজি নয়। বেশ খানিকটা সময় ব্যয় হলো তাকে লাইনে আনার জন্য।দাস তারপর জেদ ধরে যে সে পরদিন ভোর ৫টায় উঠে ট্রেক শুরু করবে যাতে অনেকটা সময় পাওয়া যায়।শেষ অব্দি সূর্য তার সঙ্গ না দেওয়ার কারনে সেই প্ল্যান বাস্তবায়িত হতে পারেনা।
পরদিন ভোরবেলা আমি সবার আগে বিছানা ছেড়ে উঠলাম প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। বাথরুমে গিয়ে দেখি বালতির জলে বরফের চাঙ্গর ভাসছে। সেই কনকনে জলে সব কাজকর্ম সারা যে কি কঠিন ব্যাপার ছিল তা আমিই জানি। বাথরুম সেরে গায়ে তিনপ্রস্থ জামাকাপড় চাপিয়ে যেই না বাইরে এসেছি,একটা দৃশ্য আমায় যাকে বলে বাকরুদ্ধ করে দিলো। ভোরের আলো সবে ফুটছে,আকাশের গায়ে তুষারধবল কাঞ্চনজঙ্ঘা। তার চূড়োয় সূর্যের লালচে আলো যেন মশাল জ্বালিয়ে দিয়েছে।রঙ বদলাচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে,আর পূর্ব আকাশ জুড়ে লাল হলুদ রঙের অপূর্ব সংমিশ্রণ। অনেকেই তখন বেরিয়ে পড়েছে,ক্যামেরার শাটার পড়ছে খচাখচ শব্দে। আমার চিৎকারে দলের সবাই উঠতে বাধ্য হলো। বাইরে এসে তাদের অবস্থাও হলো আমার মতোই। পতি অবশ্য ইতিমধ্যে তার যুগান্তকারী গবেষণা চালু করে দিয়েছে। ক্যামেরা খুলে ভিডিও করতে করতে সবাইকে একই প্রশ্ন করে বেড়াতে লাগলো-'আচ্ছা,পাহাড় চূড়ায় এমন red hot কালার কেন দেখা যাচ্ছে??' আমি সেটিকে idiotic question আখ্যা দিতে বাধ্য হলাম।(নইলে থামাচ্ছিল না)। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মায়ায় ভুলে আমরা গ্লাভস,মোজা ছাড়া বেরিয়ে এসেছিলাম বাইরে। সেই সময় শীত তার কামড় দিতে কসুর করেনি। সৌরভের পায়ের আঙ্গুল ফেটে গেল প্রচন্ড ঠান্ডায়,আমার আঙুলে ক্রাম্প ধরে গেছিলো,যেটা কিনা মোমবাতির আগুনের মধ্যে আঙ্গুলটা ধরে রাখার পর ঠিক হয়। 
ইতিমধ্যে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়,আমরা আর আধঘন্টার মধ্যে বেরিয়ে পড়বো সান্ডাকফুর দিকে। গাড়ি পিছনে আসবে পতি আর শিলাদিকে নিয়ে,মাঝরাস্তায় আমাদের তুলে নেবে। সেই মতো ব্যাগেজ গুলো পতির কাছে রেখে আমরা লাঠি নিয়ে 'দুর্গম গিরি' পথে বেরিয়ে পড়ি। রাস্তায় তখন গুঁড়ো বরফ পরে,ছোট ছোট ঝর্ণাগুলো জমে বরফ হয়ে আছে। পা পিছলাবার দারুন সম্ভাবনা। বাকি সবার সাথে আমরাও সাবধানে চলতে লাগলাম। ছবি মাঝে মাঝেই তোলা হচ্ছিল।বেশ কহানিকতা যাওয়ার পর আমরা এসে পৌঁছলাম সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল  পার্কের প্রবেশদ্বারে। সামনে বোর্ডে সতর্কিকরন- এই জঙ্গলে চিতা,ভাল্লুক জাতীয় প্রাণী আছে,সুতরাং সাবধান অভিযাত্রীগন। অবলুপ্তপ্রায় লাল পান্ডা দেখার আশায় আমরা তখন যাকে বলে ফুটছি। সিঙ্গালিলা তে ঢোকার পর রাস্তা দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদিক নেপাল বর্ডার ঘেঁষে যাওয়া,আরেকদিক জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সোজা 4 কিলোমিটার। ৯৯% অভিযাত্রীরা চলে গেল নেপাল বর্ডারের দিকে।আমরা ৬জন আর গাইড জঙ্গলের রাস্তা ধরলাম। একটা রোমাঞ্চকর অভিযানের আশায় তখন আমরা উদ্বেলিত।যদিও পাকা রাস্তা,কিন্তু সম্পূর্ণ শুনশান। আমি আবার সকলকে একটু জ্ঞান দিয়ে দিলাম যাতে কেউ বেশি পিছিয়ে না পড়ে(পিছনের লোককে লেপার্ড আগে টার্গেট করে বলে একটা জব্বর ঢপ মেরে দিলাম)। রোদের মধ্যে চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে চমৎকার লাগছিলো হাঁটতে। শুধু পিছন থেকে জিপ চলে আসবে ভাবলেই সবার মন খারাপ হচ্ছিলো একটু। চারপাশের জঙ্গল থেকে উঠে আসা বুনো গন্ধ আর দূরে অজস্র পাহাড়চূড়োর সমাহার আমাদের ক্লান্ত হতে দিচ্ছিল না। তবে হ্যাঁ,সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কে আমরা প্রায় ৩টি ঘন্টা ট্রেক করার পরেও আমরা একটি জন্তুরও দেখা পাইনি। লাল পান্ডা তো দূর অস্ত!!! ছ্যা ছ্যা!! ঘেন্না ধরে গেল আমাদের.. বিভিন্ন পাখির ডাক শুনছিলাম,কিন্তু চর্মচক্ষে তাদের দেখতে পাইনি। ওয়াসিম তো সিঙ্গালিলা'কে অভয়ারণ্যের লিস্ট থেকে বাদ দেওয়ার পক্ষে জোরদার সওয়াল করে ফেললো। মাঝে একজায়গায় দেখলাম রাস্তা সারাইয়ের কাজ চলছে,সেখানকার শ্রমিকরা সব এসেছে হাওড়া,হুগলির গ্রাম থেকে,বাঙ্গালী।নিজের জেলা থেকে দূরে এসে সেই জেলার কারো সাথে দেখা হয়ে গেলে সে যতোই সামাজিক ফারাক থাকুক না কেন!বেশ আনন্দ লাগে।একটা চড়াই পেরিয়ে ক্লান্ত হয়ে সবাই রাস্তার ধারে বসে খেজুর খাচ্ছি;এমন সময় ঘটলো সেই প্রত্যাশিত ঘটনা। শব্দটা সবার কানেই এসেছিলো।কিন্তু বিশ্বাস করতে মন চাইছিল না। তবু বাস্তবকে অস্বীকার করার উপায় কি!! দশ মিনিটের মধ্যে আমাদের গাড়ি পতি আর শিলাদিকে নিয়ে এসে দাঁড়ালো আমাদের সামনে। প্রবল অনিচ্ছা নিয়ে সবাই উঠে পড়লাম। গাড়ি ছুটলো কালিপোখড়ি লেকের দিকে। বলতেই হবে রাস্তা অতি চমৎকার ছিলো। ঝাঁকুনির চোটে পা-মাথা এদিক ওদিক হয়ে যাচ্ছিল আরকি।আমার আবার এসব রাস্তায় হেভি বমি পায়। আমি আভমিন ট্যাবলেট বুকপকেটে নিয়েই ওঠেছিলাম। ঝটপট জল দিয়ে কোঁত কোঁত করে দুটো গিলে নিলাম। সাবধানের মার নেই,মারের সাবধান নেই বলে কথা। কালিপোখড়ি লেকের ধারে গাড়ি থামানো হলো। ফটোশুটের আদর্শ জায়গা।কালো জল,স্থির,নিস্পন্দ..চারধারে তিব্বতি রঙ্গিন পতাকা লাগানো। পাহাড় ঘেরা লেকটি যেন হাজার বছরের অতীতকে বুকে নিয়ে খুব গোপনে লুকিয়ে আছে। বাইরে থেকে আসা পর্যটকদের তার বিলকুল না পসন্দ। কালিপোখড়ি থেকে একটু এগিয়েই একটা ছোট গ্রাম।সেখানে একটা কাঠের রেস্টুরেন্টে বসে গরমাগরম ম্যাগি খাওয়া হলো সবাই মিলে। সেই রেস্টুরেন্ট আসলে একটা বসতবাড়ি। বাইরের ঘরে খাওয়ার ব্যাবস্থা। একজন স্প্যানিশ অভিযাত্রীর সাথে আলাপ হলো। সেও চলেছে সান্ডাকফু।তবে সে আমাদের থেকে অনেক বেশি well equipped। এখানে একখানা চমরী গাই দেখতে পাওয়া গেছিলো।পাহাড়ের এই পরিচিত প্রাণীটি দেখতে পেয়ে আমি তার ছবি তোলার ধান্দায় গুটিগুটি এগোলাম অনেকটা।কিন্তু বিধি বাম,চমরী গাই ফটোশুটে বিন্দুমাত্র আগ্রহী হলোনা।উল্টে লেজ তুলে ভাগলবা। আমি আর কিছু না পেয়ে শেষে একটা মুরগির ছবি তুলে আনলাম।চারপা না হোক,দু পাই যথেষ্ট। কি আর করা যাবে। আমাদের যাত্রা ফের শুরু হলো সান্ডাকফুর দিকে।
ইতিমধ্যে ওয়াসিম আর পতির মধ্যে একটা মন কষাকষি শুরু হয়েছিলো।(আসলে আগের দিন টামলিং conspiracy case চলার সময় ওয়াসিম প্রথমদিকে মাইতিকে কিছুটা সমর্থন করেছিল,তারই ফলশ্রুতি)।আমাদের চলার সময় আমরা যে কটা লাঠি মানে গাছের ডাল সঙ্গে নিয়েছিলাম,সেগুলো গাড়ির ভেতরে ছাদের রডে গুঁজে রাখা ছিলো। গাড়ির ঝাঁকুনিতে সেই ডাল একটা উপর থেকে পতির গায়ে পড়ে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে ওয়াসিম'ও ভালমানুষি দেখাতে গিয়ে ডাল টা সরাতে গেছিলো। সিনেমার ভাষায় যাকে climax বলে আরকি!!
পতি রক্তচক্ষু নিয়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখলো ডালটা ওয়াসিমের হাতে। সত্যযুগ হলে ওয়াসিম হয়তো ভস্ম হয়ে যেত। তার বদলে পতি গাছের ডালটা ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দিয়েই গায়ের ঝাল মেটালো ফাইনালি। ওয়াসিম গজগজ করতে লাগলো,'এসব রাগ অন্য জায়গায় দেখাবে,আমি এসব কেয়ার করি না'। পতি কোনো উত্তর দিল না। এবং আমরা বাকিরা যে আগাগোড়াই চুপচাপ ছিলাম(এবং মজা দেখছিলাম) তা নিশ্চই বলে দিতে হবে না।
উঁচু খাড়াই রাস্তা বেয়ে আমাদের ট্রেকার এগিয়ে যাচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গের সবথেকে উচু স্থানের দিকে। রাস্তার বাঁক এতটাই সরু যে প্রতিটা বাঁকের মুখে ট্রেকার ব্যাক গিয়ারে এসে তারপর আবার উপরে উঠছিলো ঢাল বেয়ে। ব্যাক গিয়ারে আসার সময় আমরা যারা পিছনে বসে ছিলাম তাদের বুক খানিকটা হলেও দুরদুর করছিলো। ব্রেক ফসকালেই অবধারিত মৃত্যু।
রাস্তার দুপাশে গাছের সারি, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বড়ো বড়ো পাথর। অনেক পর্বতারোহী রুকস্যাক নিয়ে ওয়াকিং স্টিক ভর করে এগিয়ে যাচ্ছিল রাস্তায়। আমাদের লজ্জা লাগছিলো এভাবে গাড়ি নিয়ে উঠতে,কিন্ত আমরা নাচার। সান্ডাকফু এগিয়ে আসার সাথে সাথে ঠান্ডা বাড়তে শুরু করেছে,আমরা জ্যাকেট গলিয়ে নিলাম সবাই। বিকেভঞ্জন এসে পড়লো,সান্ডাকফু আর মাত্র ১৩ কিমি। আর নিজেদের ধরে রাখা গেল না।সবাই নেমে পড়লো গাড়ি থেকে to walk atleast the final phase of মিশন সান্ডাকফু। রাস্তার ধারে জমা বরফ,ঝাউ গাছের পাতায় বরফ,পাহাড়ের গায়ে বরফ..অজস্র বরফ আমাদের শিহরিত করে দিচ্ছিল প্রতি মুহূর্তে। এখানে আসার আগে পতি,মাইতি,ওয়াসিম যে বরফ দেখার স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল তা অচিরেই পূরণ হল। পতি অবশ্য এখানে এসেই একটা 'ব্রেন স্ট্রোকের'(মানে ওর পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা দেখে তাই মনে হচ্ছিলো আরকি) কবলে পড়তে যাচ্ছিলো,আমি দৌড়ে গিয়ে koka 6 দিয়ে বাঁচিয়ে তুললাম।অবশেষে সান্ডাকফু।The Highest point of West Bengal।আমাদের পায়ের তলায়।গ্রূপ ছবি নেওয়া হয়ে গেল চটপট। বড় একটা পাথরের উপর চেপে বিভিন্ন কেতায় আমরা প্রত্যেকে ছবি তুললাম। মাইতি আটলেটিকো দি কলকাতার পতাকা সঙ্গে না আনায় ISL ম্যাচের ফ্রি টিকিট থেকে আমাদের বঞ্চিত করলো।(ওর ধারণা ছিল এরকম একটা ছবি ATK এর ওয়েবসাইটে দিলেই ফ্রি টিকিট দেবে)। 
ঝকঝকে রোদ্দুর মাখা কাঞ্চনজঙ্ঘার অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য দেখলাম প্রানভরে। sleeping budhha এতো পরিষ্কার ভাবে বোঝা যাচ্ছিলো যেন সেটা সময়ের মার্বেল পাথরে খোদাই করা এক চিরন্তন ভাস্কর্য।মাইতি আনন্দের চোটে বরফে একটু গড়াগড়ি দিয়ে নিলো। কিন্তু এবার ফেরার পালা। সকলের মন একটা আবছা অন্ধকারে যেন ঢেকে গেল। সান্ডাকফু'তে সত্যি থাকা হবে না?? নাহ! পকেট উত্তর দিলো। 
সবাই উঠে পড়লাম ট্রেকার এর ভেতর। অন্ধকার হওয়ার আগে নেমে যেতে হবে মানেভঞ্জন এ।আমাদের পায়ের ছাপ ফেলা রাস্তা পেরিয়ে আমরা ফিরে চললাম আমাদের বেস ক্যাম্পের দিকে।কারো মুখে তেমন কথা নেই।ওয়াসিম চোখ বুজে বসে।সৌরভের চোখ পিছন দিকে। পশ্চিম আকাশে তখন টকটকে লাল আবির ছড়িয়ে সূর্যদেব অস্ত যাচ্ছেন। ক্যামেরায় ধরে রাখা হল সেই রক্তিম আভা।আমাদের ট্রেকার ছুটে চললো নিচের দিকে।
রাত ৭:৩০ নাগাদ মানেভঞ্জনে নেমে এলাম। এখানকার বিখ্যাত মাস্টারজির ঘরে ঠাঁই হলো আমাদের এই যাত্রায়।সে রাতে গল্প করে আর মাইতির 'সাজিয়ে দিলে খায়' ব্যাপারে দারুন হাসাহাসি হল। মাঝে একবার নেপাল টেলিকম আর ভারতবর্ষীয় টেলিকম এর টানাটানিতে সৌরভ দাসের ত্রিশ টাকা কেটে নেয়া ছাড়া তেমন কোন সমস্যা হয়নি। মিংমা আমাদের জন্য কিছু নেপালী মুদ্রা এনে দিয়েছিল। দাস একটা বেশ বড়োসড়ো মুদ্রা পেয়ে কি আনন্দিত। আমার অনেক লোভনীয় অফার থাকা সত্বেও সে কোনোরকম শর্তেই চুক্তিবদ্ধ হতে রাজি হলো না বদলাবদলি করার জন্য। ৭জনের জন্য ডরমেটরিতে রাখা প্রায় ১০টা বিছানায় আমরা ঘুমোলাম।এক ঘুমে ভোর। সকালে মাস্টারজির হাতে তৈরী চমৎকার কফি খেয়ে আমরা বেরোলাম শিলিগুড়ি যাওয়ার গাড়ি ঠিক করতে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে,মানেভঞ্জনকে টা টা বাই বাই করে আমরা নামতে শুরু করলাম ঠিক সকাল  ৯টা ৪৫ মিনিটে।

শিলিগুড়ি নেমে আসার পথে ঠিক ছিল যে দার্জিলিং হয়ে ফিরবো।সেই মতো চুক্তি করা হয় গাড়ির সাথে। ঘন্টাখানেকের মাথায় দার্জিলিং বাস স্ট্যান্ডে আমাদের ৭ মূর্তিকে দেখা গেল এদিক ওদিক ঘুরতে। এবং তার খানিক্ষনের মধ্যেই একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে বেশি সময় লাগলো না। আমি আর পতি ম্যাল অব্দি উঠে মার্কেটে টুপিই,হান্ডিক্রাফট,সোয়েটার দরাদরি করতে লাগলাম। পতি অবশ্য এমন সব দাম বলছিলো যাতে মারধোর খাওয়ার চান্স তৈরী হলেও পাহাড়ী লোকেরা ভদ্র বলে বেঁচে গেলাম সেযাত্রা। ওয়াসিমদের সাথে আমাদের দেখা হলো চার্চের কাছে। পুনর্মিলনের আনন্দর বদলে হালকা ঝগড়াঝাঁটি হয়ে গেল। কেন হারিয়ে যাবে? কেন ফোন করলে না? এইসব অবান্তর প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে আমরা এবার পেটের চাহিদা মেটাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। খুঁজেপেতে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে খাবার 'চুজিং' এর পালা। আমি পরিষ্কার জানিয়ে দিলাম যে আমার জন্য রুটি আর পর্ক কারি। শিলাদির ছেলে জিৎ'ও গোঁ ধরলো যে আমায় অনুসরণ করবে।শিলাদির অনেক বকাবকি,বাধানিষেধ কাজে এলো না। জিও লা মার্টস।বাকিরা চিরাচরিত মুরগির ঝোলে মনোনিবেশ করলো। তবে বলতেই হবে,সবার নানান আইটেম ভাগাভাগি করে খাওয়া জমেছিল বেশ।এরপর আবার গাড়ি এবং গন্তব্য বাতাসিয়া লুপ। চমৎকার ছোট্ট স্টেশন,আর উপর থেকে দেখা যাচ্ছে গোটা দার্জিলিং শহর।খানিক্ষনের মধ্যে ট্রেন আসবে এমন জল্পনা শুনে আমরা ওয়েট করলাম কিন্ত দেখা পেলাম না।সুতরাং ফের গাড়ি এবং রাস্তা কারো একার নয়।নামার পথে গাড়ির ভেতর একটা জোর তর্কাতর্কি হলো 'বিজ্ঞান না সাহিত্য কে মানুষকে পথ দেখায়?'। আমি আর ওয়াসিম সাহিত্যের পক্ষে,বাকিরা বিজ্ঞানের কাণ্ডারী।বেশ উত্তপ্ত তর্কাতর্কির পর ড্রাইভার মাঝখানে 'শোর মত কিজিয়ে' বলে ইন্টারফেয়ার করায় সবাই চুপ একদম। রাস্তা আঁকাবাঁকা,স্টিয়ারিং যার হাতে তার কথা না শুনে থাকা যায়।
অবশেষে সমতলে নেমে এলাম। Return to Siliguri।গাড়ি আমাদের বাস স্ট্যান্ডের কাছে নামিয়ে দিল।আমাদের hotel finder পতি আর দাস,মোটামুটি আধঘন্টার ভেতর আরেকটা হোটেলের ঘরে আমাদের ঢুকিয়ে দিল। সন্ধেবেলা আমরা ক্যাশিয়ার পতির কাছে আমাদের সব খরচপত্রের একটা হিসাব চাইবো ঠিক করলাম,যাতে মোট খরচটা বোঝা যায়।শিলাদি পতির কাছে হিসাব চাইতে পতি অমর উক্তি করলো-"আমি আমার বাবাকে হিসাব দিই না,আপনাকে কি দেবো?"ডায়ালগ শুনে আমরা ছিটকে গেলাম বলাইবাহুল্য।সে রাতে আমি আর মাইতি বাইরের ঘরে,পতি,দাস,ওয়াসিম ভেতর ঘরে নিদ্রার নিমিত্ত শয়ন করিলাম। মাইতি আর আমি অবশ্য না ঘুমিয়ে এই কয়েক দিনের জমা স্মৃতির ভাঁড়ার খুলে বসায়-হা হা হি হি হাসির বন্যা বইতে লাগলো। হঠাৎ মাইতি বললো,'আরে, ওই আলোটা কিসের??' তাকিয়ে দেখি,আমাদের ঘরের দরজায় একটা আলো মাঝে মাঝে পড়ছে আর নিভে যাচ্ছে। 'চোর ঢুকলো নাকি??' মাইতি তড়াক করে উঠে বসলো বিছানায়। আমি ব্যাগ থেকে ছুরিটা বের করে উঠলাম। ঘরের সুইচ টিপে আলো জ্বালাতেই ভয়টা একটু কমলো। পা টিপে টিপে যেই না ভেতরের ঘরে ঢুকেছি আলোর উৎস সন্ধানে,শোনা গেল ওয়াসিমের গলা-'এখানে পতির গরুর মতো নাক ডাকার চোটে ঘুম আসছে না ভাই,তোমাদের ওখানে একটু জায়গা হবে?' আমরা তো হাঁ, কিন্তু ওই লাইট?? 'আমি তো মোবাইলের টর্চটা জ্বালাচ্ছিলাম তোমরা জেগে আছো কিনা দেখতে' ওয়াসিমের করুন স্বীকারোক্তি। হাসবো না ঝাড় দেব ভেবে না পেয়ে শেষে তিনজনে বাইরের ঘরেই চাপাচাপি করে শুয়ে পড়লাম। জায়গা হয়তো কম ছিল,কিন্তু আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের জায়গাটা ছিল অনেক। ঘুম আসতে আসতে সে রাতে ৩টে বেজেছিল।
পরদিন শিলিগুড়ির বিখ্যাত উলের জিনিসের মার্কেটে আমরা আক্রমন চালালাম।যদিও আমি সেদিন শিলাদি আর জিৎ-এর সাথে একটু আলাদা হয়ে পড়েছিলাম।আমরা গেছিলাম নেতাজি কেবিনে। সেখানকার টোস্ট,ওমলেট,পোচ, চা ইত্যাদি খেতে খাসা লাগলো।পরে শুনেছিলাম,বাকিরা সেদিন কিসব সবুজ ভাতের বিরিয়ানি খেয়েছিল অন্যদিকের কোনো এক দোকানে। খাওয়ার পর কেনার পালা। শিলাদি অনেক কিছু কিনলেন।আমি দুটো শাল কিনেই ক্ষান্ত দিলাম। দাম খুব কম বলে আমার মনে হয়নি,কলকাতার ফুটপাথে এইরকম দামের জিনিস খুঁজলে পাওয়া যায়। একটা কথা বলা হয়নি যে,আমি একটা কুকরি কিনবো বলে সেই দার্জিলিঙ থেকে খোঁজ শুরু করেছিলাম,এখানেও সেই খোঁজ করে বেড়াচ্ছিলাম দোকানে দোকানে। বাকিদের সাথে দেখা হলো মার্কেটের ভেতর। ইতিমধ্যে পতি তার বাবার জন্য একটা ওয়ারলেস রেডিও আর নিজের জন্য একটা হেডফোন কিনবে বলে খোঁজ শুরু করেছে। একটি দোকানে তো চূড়ান্ত হয়ে গেল। ব্যাপারটার নাট্যরূপ এরকম-

দোকানদার- হ্যাঁ,বলুন,কি চাই?
পতি-ওয়ারলেস রেডিও আছে? আর হেডসেট?
দোকানদার-হ্যাঁ হ্যাঁ, এই দেখুন,এই যে...
(দোকানদার বেশ কিছু নমুনা বের করে দেখায়)
(পতিও দেখতে থাকে ঘেঁটে ঘেঁটে)
পতি- এইগুলো ঠিক আছে,এবার দাম বলুন দেখি?
দোকানদার-(বেশ গদগদ হয়ে)দুটো মিলিয়ে ১৩০০/- দেবেন।
পতি- না,না,অতো কে দেবে!!ঠিক করে বলুন।
দোকানদার-আপনিই বলুন না,কত দেবেন??
এরপর পতির বক্তব্যটি সম্ভবতঃ দরদামের ইতিহাসে সেরা উক্তি।
পতি- ২০০/- দেব দুটো মিলিয়ে।
আমরা ওকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিলাম,দাম শুনে খানিকটা সরে এলাম পাশ থেকে।মার পড়তেই পারে এবার।ম্যাল-এর দোকানদাররা যেটা পারেনি,শিলিগুড়িতে সেটা যে কার্যকরী হবে না তার গ্যারান্টি কে দেবে? অবশ্য দোকানদার পতির দিকে তাকিয়ে শুধু বললো,আমার দোকানের সামনের রাস্তাটা ছেড়ে দিন,সরে দাঁড়ান একটু।(বেশ ভদ্র বলতেই হবে)
পতির এই দামাদামির খবর অচিরেই মার্কেটে ছড়িয়ে গেছে বুঝে গেলাম কুকরির দর করতে গিয়ে; আমাদের দেখে পরপর ৩টে দোকানদার দরদামের মধ্যেই গেল না।সিধা গেট আউট করে দিল। কুকরি কেনা এই যাত্রায় স্থগিত রেখে একটু ফুচকা খেয়ে আমরা ফিরে এলাম হোটেলে।
বাস সন্ধে সাতটায়।আমরা সাড়ে ছটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম বাস স্ট্যান্ডে।কিন্তু শিলাদি আর জিতের দেখা নাই রে,তাদের দেখা নাই। বাস ছাড়তে মাত্র মিনিট দশেক,শিলাদি এলো দৌড়াতে দৌড়াতে with জিৎ। হাতে চাউমিনের প্যাকেট ফর ডিনার। এই বিষয়ে শিলাদির কাছে আমরা কৃতজ্ঞ যে সে রাতে আমরা ৭ জন সেই দু'প্যাকেট চাউমিনেই ডিনার করেছিলাম। কারন তাড়াহুড়োর মধ্যে রাতের খাবার নেওয়ার কথাই আমাদের মনে ছিলোনা। ১৬ ঘন্টার রাস্তা পেরিয়ে কলকাতায় ফিরে এলাম বছরের শেষ সকালবেলায়।


Comments

  1. Trip sesh howar 14months porey lekha ta howai, oi trip er onnotomo sodossyo hisabe amar kache anek beshi akorshoniyo o mojadar hoye utheche... Neutral motamot er opekhhai roilam..

    ReplyDelete
  2. পড়ে বেশ মজা লাগল ! কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবিটা বেশ লাকিলি পেয়েছিস। লেকটাও বেশ সুন্দর। তা একটা ট্রেক করেই দম ফুরিয়ে গেল নাকি ? (ভালো কথা, বাংলা হরফগুলো ঠিক মত আসেনি। একটু চেক কর।)

    ReplyDelete
  3. asole samay sujoger ovabe trek kra hche na arki.. ha,bangla word kichu jayga vul hoeche dekhchi..thk kre debo.

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

বিহার ফুড ডায়েরি

KOLKATA FOOD LEGENDS : PART 1