বিহার ফুড ডায়েরি

বিহারের রাস্তায় খানাদানা 

  টুকটাক মুখে যা পড়লো আরকি



জানুয়ারী মাসে আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য বিহারে পা রাখার সুযোগ হযেছিল এবার।রাজগিরে ঘাঁটি গেড়ে একে একে নালন্দা ,বোধগয়া,পাওয়াপুরি আর সেই সাথে রাজগিরের চারপাশে যা যা দর্শনীয় ছিল তা দেখার ফাঁকে বিহারের রাস্তার ধারে যা খানাদানা পাওয়া যায় তাও চেখে দেখতে ভুলিনি।(খাবার জিনিস কি ভোলনীয় ??)
তবে প্রথমেই বলে রাখি আমার এই খাদ্য অভিযান উপরে উল্লিখিত কয়েকটি স্থানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাই হে বিহারপুত্রগণ,"বিহার ফুড ডায়েরি" নামকরনের  দোষ নিও না।

১.লিট্টি
বিহারের খাবার বললেই আমাদের সবার মনে (তাজমহলের মত পরিচিত) যে নামটা হানা দেবে তা হলো "লিট্টি আর আলুচোখা।" আমার বাড়ির লোকেরা এই খাদ্যটিকে 'ছাতুর পিন্ডি ' বলে অভিহিত করলেও আমার খেতে চমত্কার লাগে। ফুচকার মতো দেখতে,কিন্তু নিরেট এই সেঁকা নিরীহ লিট্টি খাদ্য সমাজের শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসাবে প্রথম স্থান পেতে বাধ্য।
প্রথম পর্ব ---- পৌছবার দিন সন্ধেবেলা লিট্টির খোঁজে রাজগির বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন অঞ্চলে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলাম। আমার ধারণা ছিল বিহারের প্রায় 'জাতীয়' তকমা পাওয়া এই খাদ্যটি সবজায়গাতেই পাওয়া যাবে,কিন্তু বাস্তবে তার খোঁজ পাওয়া দেখলাম বেশ দুষ্কর। অনেকগুলো interrogation এর পর কাঙ্খিত লিট্টির খোঁজ মিলল একটি চালাঘরে। এক পাতা অর্ডার দিলাম(হ্যা,পাতা- প্লেট নয়).দুটো লিট্টি শালপাতায় ভাঙ্গা হলো। কিন্তু  হায় !হায় ! একি !!! দোকানদার সেই লিট্টির উপর ঢেলে দিল আলুর ঝোল। যা কিনা বাঙালি কচুরির সাথে সাপটে খেতে ওস্তাদ। ভগবান !!তুমি এদের ক্ষমা করো,এরা জানে না নিজেদের খাদ্য সংস্কৃতির বুকে এরা কিভাবে ছোরা বসিয়ে দিচ্ছে। মনোকষ্ট নিয়ে সেই হাইব্রিড লিট্টি শেষ করে হোটেলে ফিরলাম। 
দ্বিতীয় পর্ব ---- সন্ধেবেলার অভিযানে বিফল মনোরথ হওয়ার পর দমে যাইনি। সাহস সঞ্চয় করে দিন দুয়েক পর সকাল ৯টা নাগাদ জলখাবারের খোঁজে বেরিয়ে মোড়ের মাথায় দেখি লিট্টির ঠেলাগাড়ি দাঁড়িয়ে মনে হচ্হে। এগোলাম আরেকবার। নাহ!এবার আর হাইব্রিড নয়; আদি ও অকৃত্রিম বিহারী লিট্টি with আলুচোখা আর লঙ্কার চাটনি।(সাথে মুলো কাটা ছিল,কিন্তু তেমন ভরসা হলো না).ছাতুর সেঁকা গন্ধ,লঙ্কার ঝাল আর আলু-বেগুন সেদ্ধ নুন লঙ্কাকুচি দিয়ে মাখা।আনন্দের অতিশয্যে ৪টে ছাতুর বল পেটে চালান করার পর ভাইয়ের(সঙ্গেই ছিল,নাক-মুখ কুঁচকে) বারণে থামলাম।আহা !কি খাইলাম!! ভুলিব না। বেঁচে থাক বিহারের লিট্টি সংস্কৃতি। সস্তা আলুর ঝোল যেন তাকে কলঙ্কিত না করতে পারে।
লিট্টির ঠেলা 



এবং লিট্টি 
















তৃতীয় পর্ব ---- একটি সাবধানবাণী। কিছু বিহারের দোকানদার লিট্টিকে ডুবো তেলে ভেজে চাটনি আর আলুর তরকারী দিয়ে বিক্রি করছে। খাদ্যরসিকগনের কাছে অনুরোধ,কেনার সময় সেঁকা লিট্টি বেছে নিন।বিহারের Authentic স্বাদ গ্রহন করুন।

২.হাতা পোচ
আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি যে বিহারের খাবার বলতে হাতা পোচ কোনোভাবেই 'বিহারি' আখ্যা পেতে পারে না।তবে যেহেতু খাবারটি বিহারেই প্রথম খেলাম তাই বিহার ফুড ডায়েরিতে জায়গা দিতেই হচ্ছে। নতুন তেমন কিছু নয়,ডিমের পোচ।কিন্তু বানানোর অভিনবত্বে ও উপস্থাপনার চোটে সেটি অসাধারন লেগেছে আমার। বিয়েবাড়িতে মাংস দেয়ার ডাবু হাতা গ্যাসে বসিয়ে তাতে সামান্য তেল,রসুন কুচি দিয়ে সামান্য ভাজা ভাজা করে নেওয়া-এবার ডিম ফাটিয়ে ফেলে দাও ভেতরে।বেশ গোল আকারের হয়ে পোচ তৈরী হতে থাকবে।খানিকপরে হাতের কায়দায় চট করে উল্টে দিতে হবে।উপরে নুন,গোলমরিচের ছিটে দিয়ে শালপাতায় করে হাতে চালান।
কামড় বসাতেই গলন্ত লাভার মতো জিভের উপর হলুদ কুসুমের মার মার কাট কাট আক্রমন। অনির্বচনীয় স্বাদের সাথে হালকা উত্তাপের মেলবন্ধনের ফসল এই হাতা পোচ। কলম্বাস সম এই আবিষ্কার যে রাতে হয়েছিল,তারপর থেকে প্রতি রাতে আমায় আর ভাইকে ডিমের দোকানের সামনে লাইন দিতে দেখা গেছে। হাতা পোচ বিহারের খাদ্যতালিকায় একদম নবতম সংযোজন।








সেই হাতা পোচ >>>






৩.তিলখাজা
এই বস্তুটি বিহারে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।আমাদের যে ড্রাইভার বুদ্ধগয়া নিয়ে গিয়েছিল, তাকে তিলখাজার বিষয়ে তো রীতিমতো উৎসাহী লাগলো। কোন এক উৎসবের দিনে নাকি চিঁড়ে,দই আর তিলখাজা মেখে বিহারের গুষ্টিসুদ্ধ লোক হামলে পড়ে খায়।Very frankly speaking,এই তিল জিনিসটা ছোটবেলা থেকেই আমার জিভে একদম পোষায় না। মা আবার তিল পেলে ছাড়েন না। তাই একটা মিউচুয়াল আন্ডারস্টান্ডিং এ আসতে হয় মাঝে মাঝেই। বিহারে তিলখাজা জিনিসটা বিভিন্ন ফর্মে পাওয়া যায়। ভাঁজ করা,পাকানো,ফ্ল্যাট, ডাবল ভাঁজ ইত্যাদি।রাস্তার মোড়ে মোড়ে কাঁচের বয়াম সমৃদ্ধ তিলখাজার দোকান রাস্তার শোভা বর্ধন করছে।বাড়ির জন্য এক প্যাকেট নেওয়া হয়েছিল যা কিনা বাড়ি এসে মা একাই শেষ করেন।(সহযোগী পাওয়া যায়নি আরকি!)

৪.মিষ্টির দোকান
রাজগীরের একটা বেশ সাজানো গোছানো মিষ্টির দোকান দেখে এক সন্ধেবেলা ঢুকে পড়েছিলাম কপাল ঠুকে। মনের মধ্যে ৭০% ধারণা নিয়েই গেছিলাম যে বেমালুম ঠকতে হবে।খাস চন্দননগরের ছেলে হয়ে(আজকাল আবার চন্দননগরের ছেলে বললে  বেশ প্যাঁক খেতে হয় তাপসদার কল্যানে) বিহারের মিষ্টির দোকানে ঢুকতে মানসিক প্রস্তুতি লাগে বৈকি। প্রথমেই চূড়ো করে রাখা খাজার দিকে আঙ্গুল দেখাতেই দোকানদার একদম হাতে ধরিয়ে দিল একটা। কামড় বসালাম, চিনির প্রলেপ দেওয়া মুচমুচে খাজার ভাঁজে। জিনিসটা খুব ভালো বলা চলে না,খুব খারাপ বললেও মিথ্যাভাষণ হবে।মোটামুটি বলাটাই সমীচীন।
এরপর শোকেসে রাখা প্যাড়া(ভালোই),নারকোল সন্দেশ(জঘন্য),কাঁলাকাদ(একমাত্র ভালো মিষ্টি),মুগের নাড়ু(চলনসই) চেখে দেখার কাজ শেষ করলাম সুষ্ঠুভাবে। খাজা থেকে সন্দেশ অব্দি আমার এই উত্থান দেখে দোকানদার অতিউৎসাহী হয়ে একটা তিলখাজা প্রায় আমার শালপাতায় থ্রো করেই দিয়েছিলো, আমি 'নো' কল করে ফেরালাম।সেদিনের মতো ৪৬ টাকার বিল মিটিয়ে লজে ফিরেছিলাম।
মিষ্টির কথায় একটা পুনশ্চ যোগ করা যেতেই পারে, বিহারের সকালবেলার গরম জিলিপি বেশ উপাদেয়।চার-পাঁচটা টপাটপ খেয়ে নেওয়াই যায়।
বিহার মিষ্টান্ন ভান্ডার 

৫.ঘুগনি ফুচকা
বাঙালির প্রিয় ফুচকা বিচারেও পাওয়া যায়।আমার একটা অভ্যেস আছে যেখানে যাই সেখানে ফুচকা টেস্ট করার প্রবল ইচ্ছা আমায় পেয়ে বসে। গত দু বছরে ত্রিপুরা,দিল্লী যাওয়ার সুযোগে সেখানের ফুচকা চেখে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।তাই বিহারে ফুচকার গাড়ি চর্মচক্ষে দেখা মাত্র তার সামনে পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে বিলম্ব করিনি। বিহারে ফুচকা মোটামুটি দুরকম ফর্মে পাওয়া যায়।এক,আলু মেখে,পুর দিয়ে,জলে ডুবিয়ে আমাদের চিরাচরিত পদ্ধতিতে।দুই,ফুচকা চাট রুপে দই-টই দিয়ে। প্রথম বিভাগে বঙ্গের ফুচকার সাথে তফাৎ এই যে,ফুচকার সাইজ ছোট,আলু মাখাটা একটু বিজাতীয় গোছের আর জলটা একটু বেশি টক। অন্যের হাতের চাট খাওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না।তাই দ্বিতীয় বিভাগে পা বাড়াইনি।
তবে একদিন বেশি রাতে রাজগীর বাস স্ট্যান্ডে আমি আর ভাই এক নতুন ধরণের ফুচকার স্বাদ পেয়েছিলাম। ব্যাপারটা হয়েছিল কি,রাত হয়ে যাওয়ায় ফুচকাওয়ালার আলুর স্টক তলানিতে। প্রথমে 'নেহি হোগা' বলে দিলেও পরে কি ভেবে আবার 'আইয়ে আইয়ে' বলে পাতা হাতে ধরিয়ে দিলো। শেষ খানিকটা আলু মাখার সময় দেখি গরম ঘুগনি থপ করে দুহাতা মসলা দিয়ে মেখে নিয়ে ফুচকার পুর রেডি। তারপর জলে চুবিয়ে আমার পাতায়। মুখে পুরতেই ঠান্ডা তেঁতুল জলের আড়ালে ঘুগনির গরম ছোঁয়া লাগলো জিভে। আহা! যেন আইসক্রিম ইন হট চকলেট সসের উল্টো সংস্করণ। ফুচকা তো অনেক খাই,কিন্তু এহেন হাইব্রিড 'ঘুচকা'(সন্ধিটা ব্যাখ্যা করতে হবে না আশা করি) আগে খাওয়ার সুযোগ ঘটেনি। 'প্রয়োজনীয়তাই তো আবিষ্কারের জন্মস্থান'-একথা বিহারি ফুচকাওয়ালা সে রাতে প্রমান করে ছেড়েছে।

৬.এসব ছাড়াও পুরি সবজি,সামোসা খেয়ে দেখেছি।নতুনত্ব কিছু পাইনি।"যবতক সামোসে মে রহেগা আলু,তবতক বিহারমে রহেগা লালু"- এমন সব বিখ্যাত রাজনৈতিক ডায়লগ সামোসাকে অমর করেছে;তাই কথা বাড়ালাম না।বলা তো যায়না political intolerance এর কেসে ফেঁসে যেতে পারি।
পুরি সবজি 

বলা দরকার,বিহারে রাস্তার ধারে ঠেলাগাড়িতে একরকম লম্বা লম্বা বাদামি রঙের ডাঁটি বিক্রি হয়। খোসা ছাড়ালে ভেতরে সাদা ফল,অনেকটা শাঁকালুর মতো,শুধু আকার আলাদা।অনেকেই সেগুলো কিনে চিবাচ্ছে দেখে আমিও দুটাকা দিয়ে একটা কিনেছিলাম। জিজ্ঞাসা করে জানলাম,এটা তালগাছের থেকে পাওয়া কোন একটা প্রোডাক্ট। ঠেলাওয়ালা 'চাবাইয়ে চাবাইয়ে' বলে উৎসাহ দিতে মুখে পুরে খানিকক্ষণ চিবোলাম।বিস্বাদ ও কষাটে। 'কিস লিয়ে খাতে হ্যায়?' এই প্রশ্নের উত্তরে ঠেলাওয়ালা জানালো,'টাইম পাস করনে কি লিয়ে থোড়া এন্টারটেইনমেন্ট হ্যায়'; বেঁচে থাক বিহারের এন্টারটেইনমেন্ট,তার পদতলে পেন্নাম।

খাদ্যের বৈচিত্র্যে বিহার হয়তো বাংলার কাছে দশ গোল খাবে।কিন্তু প্রত্যেক প্রদেশ তার নিজের খাদ্যসংস্কৃতিতে উজ্জ্বল। নেহাতই পর্যটকদের জন্য সেই সমস্ত সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে বিদেশী খাদ্যের আমদানি একজন খাদ্য রসিক হিসাবে আমি মানতে পারিনা। বরং নিজস্ব খাদ্যকে কিভাবে আরো চমকপ্রদ ভাবে উপস্থাপন করা যায়,সেদিকেই নজর ফেরানো দরকার।




Comments

  1. আমার এক বিহারি বন্ধুকে অনুপ্রাণিত করে হায়দ্রাবাদে তাকে দিয়ে লিট্টি বানিয়ে খেয়েছিলাম. সেই কথা মনে প​ড়ে গেল. দারুণ খেতে :) দক্ষিণ ভারতে দুরকম ফুচকা পাওয়া যায়. তার মধ্যে যেটা উত্তর ভারতীয় রীতিতে বানানো, সেটার পরিবেশক বিহারি ফুচকাওয়ালারা.

    ReplyDelete
  2. ভালো কথা তোর বর্তমানে প্রকাশিত লেখাগুলো upload কর.....

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

KOLKATA FOOD LEGENDS : PART 1

আমার সান্দাকফু আরোহন বৃত্তান্ত